সংখ্যাগরিষ্ঠের আগ্রাসন : ভারতের মুসলমানদের অস্তিত্ব সঙ্কট

Daily Inqilab আব্দুল্লাহ

১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৬ এএম

বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারত, যেখানে বহু জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতির সহাবস্থান, সেই দেশেই আজ মুসলমানরা এক কঠিন সংকটের মুখোমুখি। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতীয় মুসলমানরা বহু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠের আগ্রাসনের যে ধারা স্পষ্ট হয়েছে, তা মুসলমানদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।ভারতের ইতিহাসে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। দিল্লি সালতানাতের আমল থেকে ব্রিটিশ শাসনকাল, এরপর স্বাধীন ভারতের সূচনা-প্রতিটি পর্যায়ে মুসলমানরা দেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে মুসলমানদের প্রতি বৈষম্য নতুন রূপ নিতে শুরু করে।

বাবরি মসজিদ ধ্বংস, গুজরাট দাঙ্গা, অসম ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (ঈঅঅ) নিয়ে বিতর্ক, মুসলিমবিদ্বেষী প্রচারণা, এসবই সংখ্যাগরিষ্ঠবাদী রাজনীতির অংশ।বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর উত্থানের পর মুসলমানদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান আরও নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। মুসলমানদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, তাদের নাগরিকত্বের অধিকার সংকুচিত করার চেষ্টা চলে।

আইনি ও সামাজিক নিপীড়ন: সম্প্রতি মুসলমানদের নাগরিকত্ব নিয়ে সন্দেহ তৈরির কৌশল নেওয়া হচ্ছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (ঈঅঅ) এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (ঘজঈ) বাস্তবায়নের মাধ্যমে মুসলমানদের ‘অবৈধ অভিবাসী’ বানানোর চেষ্টা চলছে। অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য নাগরিকত্বের সুবিধা থাকলেও মুসলমানদের ক্ষেত্রে তা ব্যতিক্রম।এর পাশাপাশি মুসলমানদের ওপর সহিংসতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মুসলিম যুবকদের বিনা বিচারে গ্রেফতার, পিটিয়ে হত্যা, মুসলিম নারীদের সামাজিকভাবে হেয় করার মতো ঘটনাগুলো সাধারণ হয়ে উঠেছে। মুসলমানদের ব্যবসা – বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও বৈষম্য বাড়ছে।

রাজনৈতিক প্রান্তিকীকরণ ও ধর্মীয় বিদ্বেষ: ভারতের রাজনীতিতে মুসলমানদের অংশগ্রহণ ক্রমেই কমছে। একসময় ভারতের সংসদ ও রাজ্য বিধানসভায় মুসলমানদের প্রতিনিধি সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ছিল, কিন্তু বর্তমানে তা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব কমিয়েদেওয়ার এই প্রবণতা গণতন্ত্রের জন্যও ভয়ংকর ইঙ্গিত বহন করে।ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করা হচ্ছে। মুসলমানদের দেশদ্রোহী, জঙ্গি বা সন্ত্রাসী হিসেবে চিত্রিত করার একটি ধারাবাহিক প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। এমনকি শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রেও মুসলমানদের প্রতি বৈষম্য স্পষ্ট।

এভাবে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠবাদী রাজনীতি চলতে থাকে, তাহলে ভারত তার বহুত্ববাদী চরিত্র হারিয়ে ফেলবে। এক ধর্মের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা কেবল মুসলমানদের নয়, বরং গোটা দেশের জন্যই বিপজ্জনক। ইতিহাস সাক্ষী, যেখানে বৈচিত্র্য দমন করা হয়, সেখানে অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়।ভারতের মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। ভারতীয় সংবিধান সকল ধর্মের মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করে, আর সেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষা করাই হবে প্রকৃত সমাধান। ইসলামের ইতিহাসে অনেক যুদ্ধেই মুসলমানরা সংখ্যাগত দিক থেকে দুর্বল অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও তারা বিজয় অর্জন করেছেন বা প্রতিপক্ষের বিশালাকার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছেন।

ইসলামের ইতিহাসে বদর, উহুদ, খন্দক, তাবুক, মুতার যুদ্ধ প্রমাণ করে যে, সংখ্যাই বিজয়ের মাপকাঠি নয়, বরং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ও তাওয়াক্কুল থাকলে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে কেউ বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন করলে নিজেদের অস্তিত্ব থাকবে না। সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর নির্যাতন, নিপীড়ন অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশসহ বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান ও শান্তিকামী মানুষ বসে থাকবেনা। আমরা নির্যাতিত মজলুম মুসলিমদের জন্য নিজেদেরকে কুরবানি করতে প্রস্তুত। আজকের যুগে ভারতে আমরা উন্নত যা কিছুই দেখতে পাই না কেন (কুতুব মিনার, তাজমহল থেকে শুরু করে প্রায় সকল ঐতিহাসিক ও উন্নত স্থাপনা, এমনকি ভারতের পতাকার আজকের নকশাও একজন মুসলমানের হাতেই তৈরি হয়েছে) সেগুলো মুসলমানদের যুগে (দিল্লি সালতানাত ও মুঘল আমলে) নির্মিত হয়েছে। মুসলমান ব্যতীত ভারতের অস্তিত্ব কল্পনাই করা যায় না।

ভারতের মুসলমানগণ ভারতের মাটিকে ভালোবাসে, তাই সেখানে তারা যুগ যুগ ধরে অবস্থান করছে। সেই দেশপ্রেমিক ভারতের মুসলমানগণ উগ্রবাদী হিন্দু দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে, বিষয়টা কোনভাবেই মেনে নেয়ার মতো নয়। তাই নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে চাইলে মুসলমানদেরকে অন্যান্য নাগরিকদের মতো সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। তাদের প্রতি অন্যায়, অবিচার ও বৈষম্য পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ মেনে নেবে না।


বিভাগ : ইসলামী জীবন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

ফিলিস্তিনে আল্লাহর সাহায্য কতদূরে
এআই দিয়ে ঘিবলি স্টাইল কার্টুন তৈরি ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্য অপরাধ
মুসলিম জাতির শক্তির ভিত্তি
ছারছীনা দরবারের দীনী খিদমত ও সংস্কারমূলক কার্যাবলি
যেভাবে হজের প্রস্তুতি নেব
আরও
X
  

আরও পড়ুন

কালিগঞ্জে প্রশাসনের নাকের ডগায় অবৈধ বালু উত্তোলন, পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা

কালিগঞ্জে প্রশাসনের নাকের ডগায় অবৈধ বালু উত্তোলন, পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-প্রক্টরের পদত্যাগ চায় ছাত্রদল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-প্রক্টরের পদত্যাগ চায় ছাত্রদল

রিয়াল ছেড়ে কেন ব্রাজিলে আনচেলত্তি

রিয়াল ছেড়ে কেন ব্রাজিলে আনচেলত্তি

দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে নিহত ঢাবি ছাত্রদল নেতা, বিক্ষোভ প্রতিবাদে উত্তাল ক্যাম্পাস

দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে নিহত ঢাবি ছাত্রদল নেতা, বিক্ষোভ প্রতিবাদে উত্তাল ক্যাম্পাস

সেমি-ফাইনালে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ নেপাল

সেমি-ফাইনালে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ নেপাল

এই প্রথমবারের মতো  ‘বাবার কারাবাস’ নিয়ে প্রকাশ্যে  কথা বললেন ইমরান খানের সন্তানদ্বয়

এই প্রথমবারের মতো ‘বাবার কারাবাস’ নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বললেন ইমরান খানের সন্তানদ্বয়

আমিরাতের উন্নয়নে বাংলাদেশিদের অবদানের প্রশংসা এবং সহযোগিতার আগ্রহ প্রকাশ

আমিরাতের উন্নয়নে বাংলাদেশিদের অবদানের প্রশংসা এবং সহযোগিতার আগ্রহ প্রকাশ

কৃষিপণ্য রপ্তানিতে ভাটা, উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা

কৃষিপণ্য রপ্তানিতে ভাটা, উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা

ব্রিফিংয়ে জয়সোয়াল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার ঘটনায় ভারতের উদ্বেগ!

ব্রিফিংয়ে জয়সোয়াল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার ঘটনায় ভারতের উদ্বেগ!

আমদানি বৃদ্ধি ও শুল্ক কমানোর পণ্য তালিকা চূড়ান্ত হচ্ছে

আমদানি বৃদ্ধি ও শুল্ক কমানোর পণ্য তালিকা চূড়ান্ত হচ্ছে

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করে না: প্রেস উইং

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করে না: প্রেস উইং

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করে না: প্রেস উইং

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করে না: প্রেস উইং

চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে পতিত সরকারের করা চুক্তি স্থগিত করুন

চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে পতিত সরকারের করা চুক্তি স্থগিত করুন

কমলো উড়োজাহাজের তেলের দাম

কমলো উড়োজাহাজের তেলের দাম

লিবিয়ায় ভয়াবহ সংঘর্ষ, বাসিন্দাদের ঘরে থাকার নির্দেশ

লিবিয়ায় ভয়াবহ সংঘর্ষ, বাসিন্দাদের ঘরে থাকার নির্দেশ

আমরা কি নতুন কোনও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছি? প্রশ্ন মেজর হাফিজের

আমরা কি নতুন কোনও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছি? প্রশ্ন মেজর হাফিজের

মঙ্গলের মাটির তলায় তরল পানির সন্ধান

মঙ্গলের মাটির তলায় তরল পানির সন্ধান

পুঁজিবাজারে আবারো বড় দরপতন

পুঁজিবাজারে আবারো বড় দরপতন

পুঁজিবাজারে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ চান বিএমবিএ

পুঁজিবাজারে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ চান বিএমবিএ

ক্রিলিক একটি পরিপূর্ণ জ্ঞান ভান্ডারে পরিণত হবে -এলজিইডি’র প্রধান প্রকৌশলী

ক্রিলিক একটি পরিপূর্ণ জ্ঞান ভান্ডারে পরিণত হবে -এলজিইডি’র প্রধান প্রকৌশলী